শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩
প্রকাশিত: সোমবার, মার্চ ১৪, ২০২২
ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
ইব্রাহিম আদহামের কথা সচেতন মানুষ জানে। তিনি প্রায় দেশ বিদেশ ভ্রমণ করতেন। একবার বহু দেশ ভ্রমণ করে জনমানবহীন অরণ্যে বসবাস করতে শুরু করেন। তাঁর কাছে মানুষের চেয়ে অরণ্যের পশুপাখি গাছপালা সংযত মনে হলো। অরণ্যে পশুপাখিরাও তাঁর সাথে জিকির করতো। বনে শিকারীরা খাঁচা ও জালের মধ্যে পাখির প্রিয় ফলফলাধি ও খাদ্যদ্রব্য রেখে পাখি শিকার করতো। ইব্রাহিম আদহাম পাখির ভাষা বুঝতে পারতেন।
পাখিদের তিনি বললো, তোমরা শিকারীর খাদ্য খাবে না। সবাই মিলে একটি স্লোগান মুখস্থ করতো, তা হলো ‘আমরা শিকারীর খাবার খাব না’। তিনি তালে তালে ছন্দে ছন্দে পাখিদের এই স্লোগান মুখস্থ করালেন। এটি মুখস্থ করাতে তাঁর এক বছর সময় লাগলো। একটি পাখি যখন বলতো ‘শিকারীর খাবার খাব না, সব পাখি তাল ও সুর মিলিয়ে বলতো। এক দিন যখন শিকারী এলো সব পাখি তখন বললো, ‘আমরা শিকারীর খাবার খাব না’।
পাখিদের স্লোগান শুনে শিকারী পালাতে লাগলো। পাখিও তাকে পিছন হতে তাড়াতে লাগলো, কিছু সময় পর কিছু পাখির দৃষ্টি খাবারের দিকে পড়ল। পাখিগুলো, ‘শিকারীর খাবার খাবনা’ স্লোগান দিয়ে শিকারীর খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। পাখির খাবারের লোভ দেখে শিকারী আবার খাবারগুলো জালের মধ্যে রাখে, দলে দলে পাখি জালের মধ্যে খাবার খেতে ঢুকতে থাকে।শিকারী আবার অনেক পাখি ধরে ফেললো।
হযরত ইব্রাহিম আদহাম পাখিদের একটি বাক্য শিখিয়েছেন কিন্তু পাখিদের এই বাক্যটির যথার্থ বুঝাননি। পাখিরা বাক্যটির অর্থ বুঝেনি। আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সন্তানদের পাখির বুলির মত অবস্থা হয়েছে। জানিনা পাখিগুলোর মত আমাদের পরিণতি হবে কিনা!
সব শিক্ষকরা বলে পড় পড় পড়।অভিভাবকরাও বলে পড় পড় পড়, বেশি করে পড়,।আমি বলি পড় কম ভাবো বেশি। আমরা সন্তানদের পড়াচ্ছি, মুখস্থ করাচ্ছি শিক্ষার যথার্থ বুঝার ব্যবস্থা করছি না। আজ যে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করছি, সে সৃজনশীল পদ্ধতির উৎস আধুনিক বিজ্ঞানীদের সেরা বিজ্ঞানী আলভার্ট আইনস্টাইনের একটি সাধারণ উক্তি ‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনাশক্তি অনেক বড়’।
এই সাধারণ উক্তিটির মধ্যে অসাধারণ যথার্থ নিহিত আছে, তা বুঝতে আমাদের সত্তর বছর সময় লাগছে। ১৪’শ বছর পূর্বেই এই কথাটিই আমরা পেয়েছিলাম পবিত্র কোরআনের ‘তাকাফ্ফুর’ শব্দটির মধ্যে। ‘তাকাফ্ফুর’ অর্থ চিন্তা করা, গবেষণা করা। ‘কোরআন’ অর্থ পড়া, ‘তেলাওয়াত’ অর্থ পড়া, ‘কেরাত’ শব্দটির অর্থও পড়া। মহান আল্লাহর পাক পড়ার সাথে সাথে চিন্তা ও গবেষণা করতে ‘ ‘তাকাফ্ফুর’ শব্দটি কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন।
আলভার্ট আইনেস্টাইনের সেরা আবিস্কার Theory of Relativity এই তত্ত্ব আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বুঝাতে তিনি আমন্ত্রন পান। আমেরিকায় গিয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বটি বুঝাতে একই বক্তব্য বারবার দিলেন তিনি। ড্রোইভার আইনস্টাইনকে বললো, সভায় আপনার বক্তব্যটি শুনতে শুনতে পুরো আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আইনস্টাইন ড্রাইভারকে বললো, তুমি আমার ড্রেসটি পর আমি তোমার ড্রেসটি পরি, পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বক্তব্যটি তুমি দিবে। ড্রাইভার পুরো মুখস্থ বক্তব্যটি দেওয়ার পর এক প্রশ্ন কর্তা বক্তব্য হতে একটি প্রশ্ন করলো।
সে তো বক্তব্য মুখস্থ করেছে, বিজ্ঞানের তত্ত্বটি আত্মস্থ করতে পারেনি। কিন্তু ড্রাইভার ছিল বৃদ্ধিমান। উত্তরে বললো, এই ছোট সাধারণ প্রশ্নটির উত্তর আমি দিবো না, আমার ড্রাইভার দিবে। ড্রাইভারের চেয়ার হতে আইনস্টাইন দাঁড়িয়ে সুন্দরভাবে উত্তরটি দিলেন, উপস্থিত বিজ্ঞারীরা ভাবতে থাকেন,আইনস্টাইনের ড্রাইভার এত জ্ঞানী হলে আইনস্টাইন কত বড় জ্ঞানী ! আশা করি বুঝাগেল মুখস্থ জ্ঞান মানে জ্ঞানী নয়, আইনস্টাইন নন। আইনেস্টাইন-নিউটনের মত বড় বড় বিজ্ঞানীদের সাধারণ অনেক কিছু মনে থাকতো না। যেমন, লন্ডনে একবার আইনেস্টাইন তাঁর বাড়ীর ঠিকানা ভুলে যায়, এক বিজ্ঞানী রেশনের জিনিস নিতে গিয়ে নিজের নাম ভুলে যায়, নিউটন মুরগীর জন্য একটি ঘর তৈরী করে বড় ছোট দুটি দরজা রাখে, একটি মুরগীর জন্য অন্যটি মুরগীর বাচ্চার জন্য।
তাঁর মাথায় আসলো না বড় দরজা দিয়ে মুরগী ও মুরগীর বাচ্চা উভয়ই বের হতে পারবে। এসবের কারণ কী ? তাঁরা কী পাগল বা মেধাহীন ছিলেন ? হ্যাঁ তা অনেকে ভাবতে পারেন কিন্তু তা নয়। তারা তথ্য জমা রাখেননি মাথায়, তাঁরা তথ্য বিশ্লেষণ করতো পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে। আমরা মুখস্থ করে শুধু মাথায় তথ্য জমা রাখি কিন্তু বিশ্লেষণ করি না। তথ্য বিশ্লেষণ করার নাম সৃজনশীলতা। কয়েক বছর আগে দেশে সৃজনশীর শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে কিন্তু আমরা সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বুঝিনা।
ইসলামের সেরা দার্শনিক ইমাম গাযযালী (রা)’র মাথায় তেমন বেশি তথ্য মাথায় রাখতে পারতেন না, তাই তথ্য ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। একদিন পথে ডাকাত দল তথ্যের ডায়েরীগুলোসহ সব টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে যায়। গাযযালী (রা)’র ভিতরের পকেটে রাখা তিনটি স্বর্ণের মোহর ডাকাতরা খোঁজে পায়নি। সে মোহরগুলো নিয়ে তিনি ডাকাত দলের পিছনে পিছনে দৌড়তে থাকেন। ডাকাতরা জানতে চাইলো তাঁর কাছে, দৌড়ার কারণ কী ? তিনি বললেন, তোমরা আমার কাছে তিনটি সোনার মোহর খুঁজে পাওনি, এসব নিয়ে যাও, কিন্তু আমার ডায়েরীগুলো আমাকে দিয়ে দাও।
ডাকাত সর্দার জানতে চাইলো, তোমার ডায়েরীতে কী আছে ? তিনি জানালেন, আমার জ্ঞান-সম্পদ। ডাকাত মোহরগুলো নিয়ে বললো, যে জ্ঞান চোরে ডাকাতে নিয়ে যেতে পারে সে জ্ঞান দিয়ে তোমার কী লাভ হবে ? কথা শুনে তাঁর চেতনা ফিরে আসে। সেদিন হতে তিনি আর লিখে লিখে তথ্য জমা করেননি, তথ্য বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। জ্ঞান সাধনার ধ্যানের মাধ্যমে তাঁর খুলে যায় অন্তরচক্ষু। তিনি হয়ে উঠেন এক আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ।