বুধবার, ৩১ মে ২০২৩
প্রকাশিত: বুধবার, মে ১৭, ২০২৩
দেনমোহর, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক একটি বিশেষ বিধান যা একজন বিবাহিত মুসলিম নারীর বিশেষ অধিকার হিসেবে পরিগণিত হয় থাকে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ এই উপহার স্বাধীন ও মুক্তভাবে দান করতে বলেছেন।’
বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিবাহ কোনো সাধারণ পণ্যের চুক্তি নয় এবং দেনমোহরও কোনো পণ্যের চুক্তিমুল্য নয় বরং এটি একজন স্বামীর উপর অর্পিত একটি দায়িত্ব একই সঙ্গে একজন স্ত্রীর অধিকার যা পবিত্র কোরআন দ্বারা স্বীকৃত। দেনমোহর বাবদ দেয়া অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।’ তাৎক্ষণিক ‘ দেনমোহর – যা চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য এবং অন্যটি ‘ বিলম্বিত ‘ দেনমোহর -যা মৃত্যু অথবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদে পরিশোধযোগ্য। বিবাহ বিলুপ্তির পরেই বিলম্বিত মোহরানা প্রদেয়।
এই মোহরানা শুধুমাত্র তখনই প্রদেয় হবে যখন এটি বকেয়া হবে। বিলম্বিত দেনমোহরে দাম্পত্য অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো প্রশ্ন নেই।স্বামীর পর স্ত্রীর নিরাপত্তাই এই দেনমোহর মঞ্জুর করার কারণ। দেনমোহর পরিশোধের দায় থেকে অব্যাহতি লাভের কোনো সুযোগ একজন স্বামীর না থাকলেও পরিশোধের ‘ তাড়া ‘ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আইনি সুযোগ কিন্তু তাঁর থাকে,যদি অপরিশোধিত দেনমোহরটি ‘ বিলম্বিত ‘ প্রকৃতির হয়।
কারণ, বিলম্বিত দেনমোহর স্ত্রী যখন ইচ্ছা তখন চাইতে পারেন না চাইলেও স্বামী তা পরিশোধ করতে বাধ্য নন।আইন মতে, দুটি অবস্থার যে কোনোটি হলেই কেবল বিলম্বিত দেনমোহর চাওয়ার অধিকার স্ত্রীর তৈরি হয়। এক. যদি স্বামীর মৃত্যু হয় বা অন্যভাবে তাঁদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক ভঙ্গ হয়ে যায়; এবং দুই, যদি স্বামী সালিসি পরিষদ তথা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে পরবর্তী স্ত্রী গ্রহণ করেন।
দেনমোহরের উদ্দেশ্য হিসেবে শুরুতে যা বলা হয়েছে তার বাইরে দাম্পত্য সম্পর্ক বলবৎ বা শান্তিপূর্ণ রাখার পেছনেও দেনমোহরের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। একজন স্বামী যখন জানবেন যে স্ত্রীকে তালাক দিলেই বিলম্বিত (ধার্যকৃত সমুদয় দেনমোহরের বৃহদাংশই সাধারণত বিলম্বিত থাকে)দেনমোহর দিতে হয় তখন সে সতর্ক থাকবে। যদিও অবাধ্য স্ত্রীর আচরণে দাম্পত্য কষ্টে আছেন, এমন স্বামীদের ক্ষেত্রে এরূপ অবস্থা কাঙ্ক্ষিত নয়।
মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯’ অনুসারে, ‘অত্র আইনের বিধৃত কোনো কিছু মুসলিম আইন অনুসারে বিবাহিতা কোনো স্ত্রীলোকের প্রাপ্য মোহর বা তার কোনো অংশের অধিকারী তার বিবাহ বিচ্ছেদের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। এমনকি মৃত্যুর পরেও না। অপরিশোধিত দেনমোহর একটি ঋণ এবং নীতিটি হল এই যে, অধমর্ণ উত্তমর্নকে অনুসন্ধান করবে। অতএব, স্ত্রী থাকলে ও স্বামীর ঠিকানা জানানো থাকলে স্ত্রী বাসস্থানটি যে আদালতের আওতাভুক্ত, স্ত্রী সেখানেই মামলাটি দায়ের করতে পারবে, বিখ্যাত মামলা তুলনা দিতে পারি এই ক্ষেত্রে শাহ বানু বেগম বনাম ইফতেখার মাহমুদ খান মামলায় বলা হছে, দেনমোহর কখনই মাফ হয় না। স্বামী যদি মারাও যায় তবে সে স্বামীর সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যায়।
মৃত মুসলমানের উত্তরাধিকারীগণ দেনমোহর ঋণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয়। মুসলিম আইনে ৪৩ ধারা অনুযায়ী মৃতের নিকট প্রাপ্য অনগদ ঋণের ন্যায়-দেনমোহর ঋণের উত্তরাধিকারীর মৃতের সম্পত্তিতে প্রাপ্য অংশের আনুপাতিক হারে প্রত্যেক উত্তরাধিকারী দায়ী হবে। মুসলিম আইনে ধারা ২৯৬ এই বিষয়টি পর্যালোচনা হয়েছে। বিধবার দেনমোহরের দাবী তাকে তার স্বামীর কোন সুনির্দিষ্ট সম্পত্তিতে কোন “চার্জ” সৃষ্টির অধিকারী করেনা। কিন্তু যখন তার “দেনমোহরের পরিবর্তে” সে প্রতারণা ব্যাতিরেকে এবং “বৈধভাবে” তার মৃত স্বামীর সম্পত্তি লাভ করে এবংতার দখলে থাকবে, সে তার দেনমোহর পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তার স্বামীর সম্পত্তি নিজ দখলে রাখতে পারবে।
★স্বামীর মৃত্যুর পর দেনমোহর আদায়:
স্বামীর মৃত্যুর পর দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর কাছে স্বামীর ঋণ হিসেবে গন্য এবং দাফন-কাফনের খরচ করার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে দেনমোহর ও অন্যান্য ঋণ পরিশোধ করতে হবে।এ ঋণ পরিশোধ না করলে স্ত্রী স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে দেনমোহরের জন্য মামলাও করতে পারে।স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হলেও এ বিলম্বিত দেনমোহর আদায় করতে হবে।স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহর পাবার অধিকারী।তারা এর জন্য মামলাও করতে পারে।তাছাড়া স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তার স্বামীর অন্যান্য ওয়ারিশদের এবং তার স্বামীর পাওনাদারদের বিরুদ্ধে জনিত দখল বজায় রাখতে পারবে।তবে সেই সম্পত্তিতে মুনাফা সম্পর্কে স্বামীর অন্যান্য ওয়ারিশদের হিসেব দেওয়া বিধবার দায়িত্ব।[বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ,১৮৭১,১৪ এম.আই-এ পৃষ্টা -৩৭৭]
★স্বামীর স্ত্রীর তালাকের পর দেনমোহর আদায়:
স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে তারপর বিলম্বিত দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্ত্রী যেই আদালতের এলাকায় বসবাস করেন ওই আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন বিবাহ বিচ্ছেদের ৩ বছরের মধ্যে।এর জন্য মাত্র ২৫ টাকা কোর্ট ফি দিতে হয়।দেনমোহরের দাবিতে কোনো বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি থেকে বেদখল করা হয় ,তবে সে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করতে পারে।
[মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব ১৯১৬,৪০ বম. পৃষ্টা -৩৪]
হিবা বিল এওয়াজের নীতি: দেনমোহরের পরিবর্তে হিবা বিল এওয়াজের নীতিও রয়েছে।১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন,মোহরানা পরিবর্তে হিবা-বিল এওয়াজ তখনই বৈধ হবে যখন স্ত্রী কোন প্রতিদান ছাড়াই স্বামীকে দেনমোহর দান করে দেয় এবং পরে স্বামী স্ত্রীর দানের “এওয়াজ” স্বরূপ কোন সম্পত্তি আলাদাভাবে দান করে,কারণ এটি মুসলিম আইনে একটি বিশুদ্ধ হিবা বিল এওয়াজ হবে এমনকি যদি স্বামী স্ত্রীকে কোন কিছু দান করেন এবং স্ত্রী স্বামীর বরবারে প্রতিদান স্বরূপ অন্য কোন দলিল মূল্যে মোহরানা অধিকার ছেড়ে দেয় তবে উহা আধুনিক প্রকৃতির একটি হিবা বিল এওয়াজ বলে গন্য হবে।
[পিএলডি,১৯৫৫,ঢাকা.পৃষ্ঠা -৩৯]
মনে রাখা প্রয়োজন দেনমোহর ও ভরণপোষণ সম্পূর্ণ আলাদা।বিবাহিত অবস্থায় স্বামীর স্ত্রীকে ভরণপোষণের জন্য যা খরচ দেয় তা কোনভাবেই দেনমোহরের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে না।আবার বিবাহবিচ্ছেদের ফলে স্বামী স্ত্রীকে যে ভরণপোষণ দেয় তাও দেনমোহরের অংশ নয়।কাবিননামায় যদি দেনমোহর হিসেবে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ না থাকে তবে স্ত্রীকে উপহার হিসেবে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দিলে তা দেনমোহর হিসেবে পরিশোধ হবে না।এক্ষেত্রে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা থাকতে হবে।স্বামীর মৃত্যুর পর বিলম্বিত দেনমোহর স্ত্রীর পাওনা ঋণ হিসেবে থাকে এবং তা পরিশোধযোগ্য এবং এ দেনমোহর পরিশোধের পরে উত্তরাধিকারী হিসেবেও সে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে নিজের অংশ পাবে।দুটোই তার অধিকার,একটির জন্য অন্যটি পরিশোধ করতে হবেনা,এমনটা নয়।
দেনমোহর নিয়ে বাংলাদেশ আইন এবং প্রচলিত ব্যবস্থার দূরত্ব। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ১০ম ধারা অনুযায়ী দেনমোহর হলো কিছু টাকা অথবা অন্য কোনো সম্পত্তি যা বিবাহের প্রতিদান হিসেবে স্ত্রী তার স্বামীর নিকট হতে পাওয়ার হকদার হয়।আরও বলা আছে দেনমোহর প্রদান সম্পর্কে কাবিনে উল্লেখ না থাকলে তা তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে এবং স্ত্রী চাওয়া মাত্র তা তাকে প্রদান করতে হবে। দেনমোহর নিয়ে সমাজে অজ্ঞানতাই বিভিন্ন সমস্যার জন্য দায়ী, আইন না জানার কারণেই নারী এবং বিশেষ ক্ষেত্রে পুরুষরাও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেক সময় দেখা যায় স্বামী অন্য বিবাহ করলেও স্ত্রী ভয়ে তালাক দেন না এই ভেবে তিনি দেনমোহর পাবেন না। অথচ মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুযায়ী সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া আরেকটি বিয়ে করলে স্বামীকে অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রীর বা স্ত্রীদের তাৎক্ষণিক Prompt (নগদ) অথবা বিলম্বিত (বাকি) দেনমোহরের যাবতীয় টাকা পরিশোধ করতে হবে। বিয়ের চুক্তিতে দেনমোহর পরিশোধের পদ্ধতি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলে দেনমোহরের সমগ্র অর্থ ‘ চাওয়া মাত্র প্রদেয় ‘ বলে ধরে নিতে হবে।১৯৮৫ সালের মুসলিম পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুসারে ,দেনমোহরের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, তা আদায়ের জন্য স্থানীয় পারিবারিক আদালতে মামলা করতে হয়।
সর্বোপরি,বিলম্বিত মোহরানা হলো একটি আইনি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় বা কোনো ঘটনা ঘটা পর্যন্ত স্ত্রী তার মোহরানার অধিকার পরিত্যাগ করে।এই প্রক্রিয়াটি সম্পত্তি পরিকল্পনাকে সহজ করার ক্ষেত্রে ,সম্পত্তির মালিককে তার অধিকার পুনরায় ফিরে পেতে ও একই সাথে তার স্ত্রীর ভবিষ্যৎ আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াকে সহজ করে।এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে বিলম্বিত দেনমোহর সবার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে,বিলম্বিত দেনমোহরের নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো এখতিয়ারের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।বিলম্বিত দেনমোহর নির্দিষ্ট পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত কিনা নির্ধারণ করতে এবং প্রযোজ্য আইন ও বিধান অনুযায়ী এটি সঠিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করতে সম্পত্তি পরিকল্পনা এবং সম্পত্তি আইন সম্পর্কে জ্ঞানী একজন আইনজীবী অথবা আইনি প্রতিনিধির পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ।
লিখেছেন:
সামিয়া হোসাইন, শিপন মহাজন, ফাবিহা রহমান, নাবিলা ফাইরুজ, ইসরাত জাহান মুনিয়া, মুজাহিদুল ইসলাম আলিফ, আনুশকা শীল, সাইফুল্লাহ হুমায়ুন চৌধুরী, মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ