সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ২৬, ২০২৩
আয়েশা ফেরদৌসী
আমার নানাজানের নাম “হাজী মরহুম সখাতুল্লাহ দেওয়ান”। তিনি ছিলেন একাধারে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী,সমাজসেবক বা সমাজ-উন্নয়নের অগ্রদূত। উনার নামে অনেক মসজিদ,মাদ্রাসা,স্কুলে পানির কল,ফ্যান,মুজাহিক বা অন্যান্য কিছু আছে যা উনার মৃত্যুর পরে আমরা জানতে পারি।
উনি আমার প্রথম আইডল। আমার ভালো কাজের উৎসাহ। আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। আমার ভালোবাসা। প্রথম প্রেমিক আমার। আমার সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী।
উনি পেশায় ছিলেন স্বর্নকার। তো, সেই সুবাদে অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীর সাথে উঠাবসা,চলাফের ছিলো উনার। আর আমি যেহেতু আমার নানাজানের অনেক কাছের ছিলাম। অনেক প্রিয় ছিলাম। ছিলাম অনেক আদর, যত্নের। ভ্রমণসঙ্গীও ছিলাম মাঝেমধ্যে। সেহেতু উনার সাথে সাথে আমারও ছোটবেলা থেকে-ই অনেক সনাতন ধর্মী বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী।
আমার খালার সই এর বাড়ি ছিলো আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই। ছোটবেলা থেকে-ই আমি টিফিন ক্যারি করি না (ভীষণ অলস আমি)। বাবার আদরের বড় কন্যা বলে সব সময় টাকা থাকতো আমার কাছে। (বাবা মা কে লুকিয়ে দিতেন আমায়) টিফিনে এটা সেটা কিনে খেতাম। তো, খালার সই এর স্বামী মিষ্টি বানাতেন বাড়িতে এবং সেগুলো বিভিন্ন দোকান বা হাটে বিক্রি করতেন। কালোজাম বলে একটা মিষ্টি ছিলো উপরে চিনি ছিটানো শুকনো টাইপের যা ছিলো খুব প্রিয় আমার। মাঝেমধ্যেই সেই মিষ্টি কিনতে যেতাম আমি উনাদের বাড়ি। কিন্তু খালা কোনদিন টাকা নিতেন না উল্টো আমার বান্ধবী সহ আমাকে ভাত না খেয়ে আসতে দিতেন না।
বড়বেলায় পি টি আই করতে যেয়ে পরিচয় হলো Mousumi Kundu। এর সাথে। আমার জুনিয়র চাকরি, বয়স, শিক্ষানবিশ সবদিক থেকে-ই। আমার পরের ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলো সে। পাশের রুমেই সিট পড়েছিলো তার। তো, তার “ফেদ্দো–সী,,,” আপা বলে এসে যখন তখন জড়িয়ে ধরা, চা বানিয়ে খাওয়ানো,পূজার নাড়ু, মুড়ি থেকে শুরু করে পিয়াজ ছাড়া খিচুড়ি এখনও ভীষণ ভাবায় আমায়। আমি অবাক হয়ে আজও ভাবি এই মেয়ে কি দেখেছিলো আমার মধ্যে, যে আজও যদি আমার একটা পোস্ট দেখে যে,আমি অসুস্থ বা বিপদে সাথে সাথে কল দিয়ে খোঁজ নিবে। আমি ভুল করলে বকা দিবে,শাসন করবে,কাটকাট কথা শুনাবে। আজও আবদার করবে– আচার খাবো আপনার হাতের (এই মেয়ে আর আমার রান্টু পাগলির Abrar Mostafa Rafid জন্য আমি আবাসিকে আচার রাখতে পারতাম না। ভাত খাওয়ার সময় অল্প দিতাম বলে চুরি করে বোয়েম সাবার করতো। এদিকে আমি আচার ছাড়া আবাসিকের খাবার খেতে পারতাম না। পরে আবার আম,চিনি কিনে দিতো। ফাজিলগুলা)
আমার হিন্দু বিয়ে দেখার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে এই মেয়ের বিয়েতে। কুমারখালির মেয়ে হলেও ঝিনাইদহ শহর থেকে তার বিয়ে হয়। টানা ৩ দিন বিয়েতে আনন্দ করেছি। বোরকা পড়ে যখন ওর শশুড়বাড়ী ওকে আনতে যাই তখন ওই বাড়ির বা প্রতিবেশিদের অবাক কিংবা বিরক্তির চোখে পড়ে যাই। কিন্তু দাদা মানে ওর বরের আন্তরিকতার কাছে সেই সব অতি তুচ্ছ, নগন্য মনে হয়। মন থেকে সব সময় দোয়া আর ভালোবাসা আসে তাদের জন্য। ভালো থেকো,ভালোবাসায় রেখো।
এরপর আসি ভার্চুয়াল বা ফেসবুকে। ভ্রমণকন্যা-Travelettes Of Bangladesh এর কল্যাণে পরিচয় হয় একমেয়ের সাথে (নাম মনে করতে পারছি না, পোস্ট চোখে পড়লে নক দিও প্লিজ, অসুস্থতার কারণে ভুলে যাই ) ২০১৯ মে বি। তো,হঠাৎ ইচ্ছে হলো ঢাকার পূজা দেখবো। পোস্ট দিলাম ফেসবুকে সেখানে এই সুন্দরী হবু ডাক্তার মেয়ে কমেন্টে আমন্ত্রণ জানালো। আর আমায় ঠ্যাকায় কে! নাচতে নাচতে চলে গেলাম ইডেন কলেজ, ঢাকার মন্ডপে। সেখানে তাদের মন্ডপ। সারাদিন তার সাথে নেচে,গেয়ে ওর বাসায় খেয়ে (ভীষণ ভালো মানুষ মাসীমা,মেশোমশাই) বিকেলে দেবী বিসর্জনের উদ্দেশ্যে ট্রাকে চাপলাম। তারপর সেই উপভোগ করতে করতে সদরঘাট।
এই হচ্ছি আমি। ছোটবেলা থেকে বড়বেলা অবধি আমি পারিবারিক ভাবে বাধাঁহীন ভাবি মিশেছি, চলেছি,খেয়েছি,খাইয়েছি। আমার পরিবার এবং আমি নিজে জানি বা মানি—
“ধর্ম যার যার,উৎসব সবার।
“সকলের তরে সকলে আমরা,প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
“সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।”
এখন অনেকে বলবেন —
তাদের ডাকুন তো আপনার উৎসবে বা কুরবানীতে।
আমি বলছি—
তাদের ডাকতে হয়নি কখনো। তারা নিজেরা-ই বহুবার এসেছেন আমার ইদের ভাগ নিতে। আমি যেমন প্রসাদ খাই না তেমন তাদেরও আমি গরু অফার করি না। এখনো যেমন পূজায় আমার নামে তারা নাড়ু,মুড়ি পাঠান আমিও তেমন খাসি, সেমাই পাঠাই।
আসুন উন্মুক্ত হয়ে চিন্তার পরিধি উন্নত করে মানুষ হই।