বৃহস্পতিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৩
প্রকাশিত: বুধবার, এপ্রিল ১৪, ২০২১
সাঙ্গু নদীকে বড্ড মিস করেন নুমে মার্মা। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে যে নদীটি বাংলাদেশের বান্দরবানের মধ্যে দিয়ে কর্ণফুলি হয়ে বঙ্গপোসাগড়ে পড়েছে, সেই নদীর পানিতে সাঁতার কেটেই যে বেড়ে উঠছিলেন নুমে!
বাবা, মা ও ভাইকে নিয়ে কি আনন্দেই না দিন চলছিল তাদের! কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন নুমেদের সংসারে। পাহাড়ের ঢালের ছোটবাড়ীর গৃহিনীর কাঁধে পাহাড়সম ভার বইয়ে দিয়ে স্বামীর অন্যত্র চলে যাওয়া। বাবা থাকতেও নেই নুমে মার্মার।
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের সময় কত আর বয়স নুমের? বাবার মুখটাও যে ভালো করে মনে নেই তার। অভাবের সংসারের হালটা অপ্রত্যাশিতভাবে নিজের হাতে আসায় দিশেহারা হয়ে নুমেকে আশ্রমে দিয়ে দেন তার মা। এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।
নুমে মারমার ভাই বান্দরবান সদরে চাকরি করেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। তাকে শহরেই থাকতে হয়। নুমের বসবাস লামায় অনাথ আশ্রমে। সঙ্গু নদীর পাড়ের বাড়িতে এখন একাই থাকেন তার মা।
নুমে মার্মা- খেলাধুলার খোঁজ-খবর যারা রাখেন তাদের কাছে নামটি পরিচিতই। দেশের যে ক্রীড়া ডিসিপ্লিনগুলো সম্ভাবনার আলো ছড়াচ্ছে তার একটি কারাতে। নুমে মার্মা একজন উদীয়মান কারাতেকা।
সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে একক কাতায় স্বর্ণ জিতেছেন এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী হুমায়রা আক্তার অন্তরাকে হারিয়ে। চার ইভেন্টে অংশ নিয়ে জিতেছেন আরো তিনটি ব্রোঞ্জ।
কারাতের সিনিয়র খেলোয়াড় ও এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী হাসান খান সানের মুখে নুমের প্রশংসা, ‘আগামীতে কারাতে ডিসিপ্লিনে যে কয়জন সম্ভবনাময় খেলোয়াড় নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায় তাদের অন্যতম নুমে মার্ম। পরের এসএ গেমসে তাকে নিয়ে আশাবাদী হতে পারে সবাই।’
মায়ের সঙ্গে নুমের দেখা হয় না ৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে। লামার যে আশ্রমে থাকেন নুমে সেখান থেকে বাড়ি পৌঁছাতে সবমিলিয়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। সময়, যাতায়াত খরচ- সবকিছু মিলিয়ে ডিসেম্বরের পর আর বাড়িতে যাওয়া হয়নি তার। তবে ফোনে মায়ের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন, খোঁজ-খবর রাখেন।
জ উ প্রু নামের এক পাহাড়ি নারি এবং তার স্বামী সিং মং মিলে লামায় যে আশ্রমটি চালান তার নাম মহামুনি শিশু সদন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ৯ বছর বয়সে ২০১১ সালে নুমে মার্মাকে তার মা এই আশ্রমে দিয়ে যান। তারপর থেকে লামার এই আশ্রমই হয়ে উঠেছে তার ঠিকানা। এখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ, এখান থেকেই এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী নুমে। নিজের কিছু হাতখরচ ছাড়া আর কোনো টাকা-পয়সাই লাগে না নুমের। সব খরচ বহন করে আশ্রম কর্তৃপক্ষ।
আশ্রমের মালিক জ উ প্রু কারাতেরও একজন প্রশিক্ষক। যে কারণে, মহামুনি শিশু সদন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কারাতের চর্চাও হয়ে থাকে। কারাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যুব গেমসে অংশ নিয়ে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটান নুমে- একটি স্বর্ণ ও ২টি ব্রোঞ্জ জেতেন বড় কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম অংশ নিয়ে।
বান্দরবান জেলার হয়ে এরপর জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলোয় নিয়মিত অংশ নিতে থাকেন নুমে। ২০১৮ সালের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে একটি রৌপ্য, পরের বছর একটি ব্রোঞ্জ পান বান্দরবানের এই কারাতেকা। একই বছর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ২টি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য জিতে চলে আসেন প্রচারের আলোয়।
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান গেমস ও এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে একাধিকবার করে স্বর্ণজেতা জাপানের নারী কারাতেকা কিয়ো সিমিজু প্রিয় খেলোয়াড় নুমে মার্মার। সময় পেলেই ইউটিউবে জাপানি এই কারাতেকার খেলার ভিডিও দেখেন নুমে। আর স্বপ্ন দেখেন বড় খেলোয়াড় হয়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনার।
পাহাড়ঘেরা বান্দরবানের লামার সেই আশ্রম থেকেই নিজের স্বপ্নটা বড় করছেন নুমে। বলতে গেলে ১৯ বছরের এই পাহাড়ি কন্যার স্বপ্নটা পাহাড়ের মতোই বিশাল। ‘সর্বশেষ নেপাল এসএ গেমসে আমি খেলেছি। ওখান থেকেই আমাকে অনেকে চিনেছেন। আমি চাই একজন কারাতে খেলোয়াড় হিসেবে আরো বেশি মানুষ আমাকে চিনুক। অলিম্পিকে খেলা একজন ক্রীড়াবিদকে মানুষ যেভাবে চিনে আমি সেভাবেই পরিচিত হতে চাই। এসএ গেমস, এশিয়ান গেমস ছড়িয়ে যেন অলিম্পিকে খেলতে পারি সেই চেষ্টা থাকবে আমার। যাতে আমার প্রতিষ্ঠান, আমার শিক্ষক, আমার এলাকা এবং আমার দেশের নাম থাকে সবার মুখে’- লামার আশ্রম থেকে বলছিলেন সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণজয়ী কারাতেকা নুমে মার্মা।