বৃহস্পতিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৩
প্রকাশিত: শনিবার, এপ্রিল ২৪, ২০২১
পল্লী গাঁয়ের এক বন্ধু নাম তার সেলিম। গ্রামেই বসবাস। তিন সন্তানের জনক। দৃশ্যমান আয়-রোজগার না থাকলে ও ভালই চলছে সংসার। সারাদিন টু টু করে দিন কাটান। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করি, কেমন চলছে দিনকাল? সহজ সরল উত্তর,আল্লাহ কাউকে না খাইয়ে রাখেন না। ডাল ভাত খেয়ে পরে কোনোরকমে বেঁচে আছি।
অনেকদিন পর পর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় বলে একটু মাঠে ঘাটে ঘুরাফিরা করি। চা দোকানে প্রায় সময় আড্ডা মারা হয়।পাহাড় পর্বত, নদী, মাঠ-ঘাট , আত্মীয়-স্বজনের বাসা-বাড়ি দেখতে দেখতেই কর্মস্থলে ফেরার সময় চলে আসে। বাড়ির খুব নিকটেই রয়েছে পাহাড় আর বন জংগল। এক সময় শিয়ালমামা হুক্কা হুয়া ডাকত। মাঝে মাঝে হাতির দাবড়ানো খাওয়া লাগত। সাপ-বেজির খেলা কত দেখেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। রাত্রে হাঁটার সময় রাস্তা সংলগ্ন সওদাগরের বাড়ির পার্শ্বস্থ বাঁশ ঝাড়ের অন্ধকার ছায়া পার হতে জিন,পরি আর দৈত্তের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিন কুল আর আয়াতুল কুরশী কতবার যে পড়েছি, সেকথা মনে পড়লে শুধু হাসি পায়। এখন গ্রামের ইট পাথরের পথ দিয়ে হাটলে ওসব আর দেখা মেলেনা।
বন্ধুর সাথে হাত ধরে হাটছিলাম। গল্প চলছিল। মাঝে মাঝে তুলে ধরছে কঠিন কঠিন প্রশ্ন । কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। পাহাড়কে মাঝে মাঝে সে পর্বত বলে উঠে। কোন কোন সময় টিলাকে ও পাহাড় বলে। আমি আপত্তি জানালাম। বললাম, পাহাড় আর পর্বত সম্পর্কে তোমার ধারণা ঠিক নয়। মাটির উঁচু স্তর বা স্তুপকে বলে পর্বত । অপেক্ষাকৃত কম উঁচু মাটির স্তুপকে বলে পাহাড় । আর তারচেয়েও ছোটগুলোকে বলা হয় টিলা । আর অনেকগুলো পর্বতকে একসঙ্গে বলা হয় পর্বতমালা । পাল্টা প্রশ্ন- কতটুকু উঁচু হলে পাহাড়, আর কত উঁচু হলে পর্বত বলব? আমি বললাম এর সুনির্দিষ্ট কোন মানদন্ড নেই। কারণ একেক দেশে একেক মানদন্ড। যুক্তরাষ্ট্রে ১০০০ মিটার, যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে ২০০০ মিটার উঁচু স্তুপকে পর্বত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমার জানামতে বাংলাদেশে ৬০০ মিটার এর উঁচু স্তুপকে পর্বত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং দেশ বা স্থানভেদে পর্বতের মান নির্ধারণ করা হয়। বুঝেছিস বন্ধু! যেটা সেটা দেখলেই পর্বত বলিস না।কথা শেষ করলে একটু মুচকি হেসে বলে তোরা পন্ডিত মানুষ, তোদের সাথে পেরে ওঠা কঠিন।
কিছুদূর যাওয়ার পর একটা গিরগিটি দেখে আমার বন্ধুটি গিরগিটিকে মারার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠে পড়ল। একটা ঘুঘুকে শিকারের জন্য হাতের ঢিল ছুঁড়ে মেরে দিল।আমি বললাম, এ কী করছ? তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শেষমেষ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসলে পরে তাকে বলি, এরকম করোনা ভাই। এগুলো পরিবেশের সম্পদ। তার প্রশ্ন? কীসের পরিবেশ? ছোট বেলায় বইয়ে পড়েছি বাড়ির চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়ে আমাদের পরিবেশ। জংগলের ভিতর আমাদের বাড়ি ও নেই, উঠান ও নেই। এখানে আবার পরিবেশ কী? তাকে কিভাবে জবাব দিব- ভাবতে ভাবতে নিজের কথা না বলে সরাসরি মার্সটিন বেটস নামীয় এক পন্ডিতের বক্তব্য উদ্ধৃত করলাম। তাঁর মতে “ পরিবেশ হল সেই সকল বাহ্যিক অবস্থার সমষ্টি যা জীবনের বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে’’। বুঝিয়ে বললাম বাহ্যিক অবস্থা কী কী? বায়ু , নদী , পানি –এছাড়া আরো কত কিছু এবং এর সাথে জীবনের বিকাশের সম্পর্ক কত ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মাইল তিনেক হাটা হয়ে গেল। একটি ছোট চরা পার হতেই চোখে পড়ল অনেক বালির স্তুপ। বালি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। আরো কিছুদূর অগ্রসর হলে পরে চোখে পড়ে ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাহাড়ের অংশ খোদাই করে ট্রাক ভর্তি করে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কেন করা হচ্ছে? কারা করছে? এর ক্ষতি কী জান? বন্ধু বলল , খালটি ইজারা নেওয়া হয়েছে বালি উত্তোলনের জন্য। খালের পরিমাপ সুনির্দিষ্ট। কতদুর জায়গা থেকে বালি উত্তোলন করা যাবে তার আছে একটি চৌহদ্দী। বাস্তবতা হলো এত বালি খালে নেই। তাছাড়া ইজারাদার অনেক মূল্যে খালটি ইজারা নিয়েছেন। তার মুনাফার একটি বিষয় আছে। খাল থেকে বালু তোলা কষ্টকর, ব্যয়বহুল। তাই এদিক ওদিক চিন্তা না করে পাহাড় কেটে নিলেই সুবিধা। এত ভিতরে কে তদারকি করতে বা দেখতে যায়। তাছাড়া সব ডিপার্ট্মেন্টকে তো মাসে মাসে মাসোহারা দেয়া হয়। তাই কেউ খুব একটা ঝামেলা করেনা। আর ঝামেলা করবে কে? ঝামেলা করার একমাত্র এজেন্ট হলো ইজারাদারের লোক। বন্ধু, ক্ষতির বিষয়ে কথা বলছ- এসব কাগজে কলমে আর ভাষণে। দেশের কথা এত চিন্তা করার সময় কার আছে। নিজেকে নিয়ে ভাব। ছেলে মেয়ে অনেক সুখে থাকবে। তোমি না খেয়ে থাকলে কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসবেনা। উলটো সবাই মজা করবে, উপহাস করবে।
বন্ধুর কথায় কী জবাব দেব-ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছিলামনা। কারণ; সে যা বলেছে সেটাই বাস্তবতা । আর আমি যাই বলব সব বই পুস্তকের কথা। বই পুস্তকের কথা বলে সান্তনা দেয়া কঠিন। মনে মনে পরিকল্পনা করলাম, প্রথমে কুরআন হাদিস, পরে বিজ্ঞান, যুক্তিতর্ক, সবশেষে তথ্য উপাত্ত, আইন-কানুন ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করব। পবিত্র কুরআনের সূরা লোকমানের ৩১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, “তিনি পৃথিবীতে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন, যাতে তা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে”। এর ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, পৃথিবী অনেকগুলো স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত যা চোখে দেখা যায়না। পাহাড়কে স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুরা আন-নাহলের ১৬ ও সূরা আম্বিয়ার ২১ নং আয়াতের তাফসিরে ইসলামি স্কলারগণ বলেছেন যে, মহাশূন্যে আবর্তনের সময় পৃথিবীকে আন্দোলিত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ পাহাড় ও পর্বত সৃজন করেছেন।
আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে ডা. ফ্রাংক প্রেস সর্বপ্রথম বলেছিলেন, পর্বতের অত্যন্ত গভীর শিকড় আছে পৃথিবীর অভ্যন্তরে। সত্যিকার অর্থে পর্বত একটি ভাসমান বরফ বা খুঁটির মতো, যার ৯০ শতাংশ থাকে পানির নিচে আর ১০ শতাংশ থাকে ওপরে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, পাহাড় সৃষ্টির আগে পৃথিবী অস্বাভাবিক উত্তপ্ত ছিল। পর্যায়ক্রমে তাপ বিকিরণের কারণে পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়ে সংকুচিত হতে থাকে। ভূপৃষ্ঠের ভেতরের অতিরিক্ত চাপের কারণে তার কিছু অংশ ওপরের দিকে ভাঁজ হয়ে ফুলে উঠতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, যে ভারী ভারী বৃহদাকার প্লেটগুলো পৃথিবীর ওপরে শক্ত স্তর সৃষ্টি করে, সেগুলোর নড়াচড়া আর সংঘর্ষের ফলেই উত্পত্তি ঘটে পর্বতমালার।
এই পাহাড়, পর্বত এর প্রয়োজনীয়তা কাগজে কলমে লিখে শেষ করা যাবেনা। এটা এমন এক ধরনের উপযোগিতা যা খালি চোখে দৃশ্যমান নয়। প্রকৃতি মাঝে মাঝে রুক্ষ আচরণ করছে, শীতকালে তীব্র শীত, আবার গরমকালে মারাত্মক গরম অনুভূত হচ্ছে। কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমরা ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রান্ত করছি। আমার কথা শুনে বন্ধু সেলিম শুধু মাথা নাড়ায়।
কিছুক্ষণ পর সেলিম আমায় জিজ্ঞেস করলো –বাংলাদেশে পাহাড় কর্তন এটা কী নতুন কিছু? সরকারি, বেসরকারি অনেক কাজেই তো পাহাড় কর্তন করা হচ্ছে। পাহাড় কর্তন না করলে উন্নয়ন কাজ চলবে কেমনে ? বস্ততপক্ষে সেলিম এর কথার সত্যতা রয়েছে। বাংলাদেশে পাহাড় কর্তন একেবারেই নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশরা ১৭৬০ সালে পাহাড় কর্তনের মাধ্যমে অফিস –আদালত স্থাপন করে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। ১৮৭২ সালে চট্রগ্রাম সিটিতে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৮৭৮০ জন। চট্রগ্রামে বন্দর থাকার সুবাদে জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৫০ সালে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে গিয়ে নাসিরাবাদ, পাহাড়তলি, ফৌজদারহাট, ভাটিয়ারি এলাকায় পাহাড় কেটে কিছু শিল্পায়ন হয়। এর পর থেকে একের পর এক পাহাড় কর্তন চলতেই থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত চট্রগ্রামে প্রায় আড়াই শতাধিক ছোট-বড় পাহাড় আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে। “বেলা” র তথ্য মতে সিলেটে ৩০০ টিলার মধ্যে প্রায় ৭০% টিলা বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানিগুলো কেটে সাবাড় করে ফেলেছে।
সেলিম এর অপর প্রশ্নটি ছিলো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত। এটা সত্য যে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছু পাহাড় কর্তন করা লাগবে। তবে তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে কী বর্ণিত আছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা। জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য পাহাড় অপরিহার্য। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (১৯৯৫ সনের ১ নং আইন) আইনের ৬(খ) ধারায় বলা আছে “কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবেনা।“ তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে পাহাড় কর্তন বা মোচন করা যেতে পারে।
সেলিম আমার কথার সাথে আরো কিছু যোগ করে বলল, কেউ শখ করে পাহাড় কাটেনা। গ্রামে ও শহরে গরিব মানুষরা থাকবে কই? কিছু জায়গায় বর্ষাকালে পানি উঠে, একটু ভরাট না করলে পানিতে ডুবে যাবে। মানুষ বাসা বাড়ি বানাতে চায়, বাসা বানাতে মাটি ভরাট করা লাগে। রাস্তা ঘাট লাগে, তার জন্য ইট দরকার, ইটের জন্য মাটি দরকার। অতিরিক্ত খাদ্য শস্য দরকার , জুম চাষ করে ফসল ফলায়। এসব করতে গেলে পাহাড় কর্তন বা মোচন করা লাগে। আমি বললাম, চমৎকার বলেছ বন্ধু। আরেকটু যদি বলতে -এসব কর্তনের ফলে কী কী প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজ জীবনে? আমার প্রশ্নে তার পিপাসা ধরে গেল। সে পানির ঢুক গিলছিলো। আমি বললাম, এবার আমার কথা শোন- পাহাড় কর্তন বা মোচনের ফলে বন ওজাড় হয়ে যাচ্ছে, জীব-বৈচিত্র ধবংস হয়ে যাচ্ছে, পাহাড় ধসে জীবন নাশ, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিকম্প বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয়সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। তোমাকে আরো কিছু তথ্য উপাত্ত দিই যাতে বিবেচনা করতে সহজ হয়। ২০০৭ সালে কেবল চট্টগ্রামেই পাহাড়ধসে ১২৭ জন মারা গিয়েছিল। এরপর ২০১৬ ছাড়া প্রতিবছরই কমবেশি মানুষ মারা গেছে। এর বাইরে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ধসে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে।
২৪টি আবহাওয়া স্টেশনে সংগৃহিত ৩০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বার্ষিক গড় হিসেবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রতি বছরই একটু একটু করে বাড়ছে। একই সঙ্গে সর্বনিন্ম তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। বার্ষিক গড় তাপমাত্রায় ঊর্ধ্বগতির ফলে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিধি আশংকাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমুদ্রপৃষ্ঠে মাত্র ১ মিটার উচ্চতাকে মোকাবেলা করার খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বা এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জলবায়ূগত পরিবর্তনের ফলে তৈরি নানা সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ উপকূলবাসী। তাদের পুনর্বাসন করার খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা বা ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আর এক হিসেবে দেখা গেছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মাথাপিছু ১২ ডলার করে মোট প্রয়োজন হবে প্রায় ১২০ কোটি মার্কিন ডলার। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে এর প্রভাবে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি কমে যেতে পারে ২৮ থেকে ৫৭ ভাগ।
বিশ্বব্যাংকের কার্যপত্রে প্রকাশিত নিরীক্ষায় দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাত্র এক মিটার বাড়লে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ তার জিডিপিতে সর্বোচ্চ দশমিক ৭ শতাংশ ক্ষতির শিকার হবে। যদি ৫ মিটার বাড়ে তবে বাংলাদেশে জিডিপির ৯ শতাংশ ক্ষতি হবে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৫-১০০ মিলিয়ন প্রজাতির জীব আছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তার মাত্র ২ মিলিয়ন খুজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন। পরিসংখ্যানে আরও বলা হয়, ১৭হাজার ২’শ ৯১টি জীবপ্রজাতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এ বিলীণ হতে যাওয়া প্রাণীকূলের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। আর এসবের পিছনে সরাসরি হাত রয়েছে মানুষের।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, বর্তমানে পরিবেশের উপর যে ধবংসাত্মক কার্যক্রম চলছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০-৭০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), যা বর্তমানে ৩৫০ পিপিএম।
আমার কথা শুনতে শুনতে বন্ধু ঝিমাতে লাগল। একটু হাত নাড়া দিলাম। হালকা ঝাঁকি দিয়ে বললাম, আমার কথা বুঝতে পেরেছ কি? বুঝতে পেরেছি ! তবে কারো কাজের সাথে বাস্তবতার মিল নেই। সবাই মুখে খই ফুটায় কিন্তু বাস্তব জীবনে কোন প্রয়োগ নেই। আমি ঢালাওভাবে এসব মন্দ শব্দের ব্যবহার না করার জন্য তাকে অনুরোধ করি। বললাম, এখনো অনেক ভাল অফিসার রয়েছে যারা জীবনের চেয়ে দেশকে বেশি ভালবাসে। তারা শুনলে কষ্ট পাবে। কাজে স্পৃহা হারিয়ে ফেলবে। এখনো যতটুকু পাহাড়, পর্বত টিকে আছে ওটা তাদেরই অবদান।
সেলিম আমার কাছে পাহাড় কাটা নিয়ে কোন আইন আছে কি-না জানতে চাইল। আমি বললাম, বিল্ডিং কন্সট্রাকশন আইন, ১৯৫২ এর ৩(সি) ধারা মোতাবেক পাহাড় কর্তন নিষিদ্ধ। ১০(এ) ধারা মোতাবেক উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে পাহাড় কাটা সরঞ্জাম জব্দ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ১২ ধারায় জেল-জরিমানার পরিমাণ (২-৭ বৎসর) নির্ধারিত আছে। পরিবেশ আইনে কি কিছুই নেই? বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (১৯৯৫ সনের ১ নং আইন) আইনের ৬(খ) ধারা মতে ও পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ। তবে এই আইনে শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সার্কুলারের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়ে থাকে।
কথার ফাঁকে ফাঁকে জানলাম বন্ধু সেলিমের বেকার জীবনের ইতিকথা। আসলে সে বেকার নয়। পাহাড় কাটা চলে মূলতঃ তারই নেতৃত্বে। তাকে “পাহাড় খেকো” বলা যায়। মাসিক আয় অনেক মোটা। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। তার চোখে মুখে অনেক স্বপ্ন। ভবিষ্যতে বড় নেতা হতে চায়। এই নেতা হওয়ার জন্য প্রয়োজন অর্থ। এই অর্থের সংস্থান করছে পাহাড়, নদী আর বায়ু তথা পরিবেশের উপর অত্যাচার চালিয়ে। সবশেষে তাকে অনুরোধ করেছিলাম, গাছ কাটলে গাছ হতে পারে। বীজ ফেললে চারা হয়, সে চারা একদিন মহীরুহে পরিণত হতে পারে। কিন্তু যে পাহাড় বা যে টিলাটি কেটে ফেলে সমান করা হলো প্রকৃতির নিয়মে প্রতিষ্ঠিত সে পাহাড়টি কিংবা সে টিলা আর মানুষের পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই এসো, সকলে মিলে পাহাড় রক্ষায় যত্নবান ও দায়িত্বশীল হয়।
লেখক: পরিচালক- পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চল।