বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩
প্রকাশিত: সোমবার, মে ১৭, ২০২১
জিটাল নিরাপত্তা আইন যে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্য সেটা আবার প্রমাণিত হয়েছে প্রথম আলো’র সিনিয়র প্রতিবেক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিস সিক্রেসি আইনে মামলা দায়ের করার মাধ্যমে।
এ আইনটি যখন সংসদে পাশ হয় তখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’
কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক সময়ে উপলব্ধি করেছি এ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন না আইসিটি আইনে সাংবাদিকেরা বেশি হয়রানি, মামলা আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
১- চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খুলনার সিনিয়র সাংবাদিক এনটিভির খুলনা ব্যুরো প্রধান আবু তৈয়বকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এ সাংবাদিকের মামলার বাদী হয়েছেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে খুলনা সদর থানায় ২৫ নম্বর এ মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়।
২- ২০২০ সালের মে মাসে বাংলাদেশের পুলিশ জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর এবং লেখক মুশতাক আহমেদকে ঢাকার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
তাদের বিরুদ্ধে “ফেসবুকে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো”, “জাতির জনকের প্রতিকৃতি”, “জাতীয় সংগীত” এবং “জাতীয় পতাকাকে” অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।
মুশতাক আহমেদ ‘কুমির চাষের ডায়েরি’ নামে বইয়ের লেখক, তিনি “মাইকেল কুমির ঠাকুর” নামে একটি ফেসবুক পাতাও পরিচালনা করেন, যাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্যও উঠে আসতো।
তিনি বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষ শুরু করেছিলেন।
সে সৃয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেছেন, এই আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়া যাবে না-এমন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এ তিনটি ঘটনাসহ রোজিনা ইসলামের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। সরকারি কর্মকর্তারা দূর্নীতি,অনিয়ম যেটা খুশি করতে পারবে। কোনো ডকুমেন্টস নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। যদিও সেটা কোনোভাবে করতে যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত কর্মকর্তার বক্তব্য বা তার মতামত কি সেটা নিতে গিয়ে নতুন করে ঝামেলায় পড়তে হয় গণমাধ্যম কর্মীদের। কারণ সবকটি সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে গণমাধ্যমে কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশে এমন একটি প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে, সাংবাদিকতা করা যাবে তবে নেতিবাচক নয়, পজেটিভ। দূর্নীতি অনিয়মের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা যাবে না, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পাঠানো প্রেস রিলিজে তারা যেটা বলে সেটাকে নিউজ করতে হবে এর বাইরে যাওয়া যাবে না। এক কথায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ধংস হয়ে গেছে, প্রেস রিলিজ সাংবাদিকতা করতে হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যা বলা হয়েছে:
“কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এজন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।” সূত্র: বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কি রয়েছে?
• ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জন শৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে।
• আইনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এজন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
• আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
• ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।
• কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের বিষয়েও বিধান রয়েছে এই আইনে। সেখানে ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম. কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, এমন ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন এবং এজন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা এনধিক এক কোটি অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
• ছবি বিকৃতি বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে কারো ব্যক্তিগত ছবি তোলা, প্রকাশ করা বা বিকৃত করা বা ধারণ করার মতো অপরাধ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ইন্টারনেটে পর্নগ্রাফি ও শিশু পর্নগ্রাফির অপরাধে সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• কোন ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া অনলাইন লেনদেন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে।
• ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এর মধ্যে করা সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।
ইমরান এমি
গণমাধ্যম কর্মী, চট্টগ্রাম।